একটি সুন্দর মুহুর্ত, ভবিষ্যতের কথা
রাখা ও দেয়ার হয়ে যেতে পারে এমন করেই বিলীন। অথবা কর্মব্যস্ত আত্নকেন্দ্রিক কোন
ভাবনাও হয়ে যেতে পারে মুহুর্তের মাঝেই অর্থহীন। কে জানে, আমাদের কোন হেয়ালিপনায়
পৃথিবী কোন মুহুর্ত বেছে নিচ্ছে সব কিছু ধ্বংশের । এমনটায় অপেক্ষমান পৃথিবির বিজ্ঞানীরা, আর তাদের
সাথে সাথে প্রস্তুত এর সাথে জড়িত মানুষজন। কিন্তু সম্পুর্ন গোপনে। যদিও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কোন গোপন বিষয় নয়, এটা ভয়াবহ আলোচিত বিষয় গুলোর মাঝে নিঃসন্দেহে অপ্রতিদ্ধন্দী। কি হতে পারে, আর কি এরই মাঝে ঘটে গেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে?
“আমরা একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহে অনিয়ন্ত্রিত এক
বিরাট পরীক্ষানিরীক্ষার মাঝামাঝিতে রয়েছি।”
মনে মনে একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। দুনিয়ার বুকে সব কিছু রয়ে গেল, যেমন আছে এই প্রকৃতি, তার সৌন্দর্য্য তার
যাবতীয় সম্পদ। শুধু সেখানে নেই কোন মানুষের উপস্থিতি। সবুজ ঘাসের বুকে আর কোন অবোধ শিশু প্রজাপতির পিছু ছুটবে না!! অস্তমান সুর্যের গাঢ় রক্তিমে কোন মানব
মানবী হাতে হাত রেখে
হাটবে না!!! সন্দেহ নাই আঁতকে ওঠার মতো বিষয়। এই প্রকৃতি এই বিশ্বজগত মনুষ্যবিহীন হয়ে যাবে!! কি ভয়ংকর
কথা।
কিন্তু মানুষ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির স্বপ্রাণ সজীব অংশ ‘মানুষ’। প্রকৃতির, যে সচেতন অংশ চিন্তা করার ক্ষমতা আছে বলে প্রকৃতিকে
রক্ষা, তার লালন পালনের ভার হাতে তুলে নেয় — প্রকৃতির সেই সচেতন অংশই হলো মানুষ। সে হিসাবে মানুষ নিজেই তো প্রকৃতি। পুনরুৎপাদনের মধ্য দিয়ে
প্রতিনিয়ত মানুষ নিজেই
বিনির্মাণ করে তার প্রকৃতির।
ফরাসি নৃতাত্বিক সমাজবিদ ক্লদ লেভি স্ট্রস। কার্ল মার্ক্সের অনুসারী এই সমাজ বিজ্ঞানী বেঁচেছিলেন প্রায় ১০০ বছর। লেভি-স্ট্রসের ১৯৫৫ সালে লেখা
অটোবায়োগ্রাফি “Tristes Tropiques.” বাংলা করলে দাঁড়ায় মন ভার করা
বিষয়-আশয়’র একটা রিভিউতে ক্লদ লেভি স্ট্রস লিখেছেন "The world began without the human race and will certainly
end without it,” ...মনুষ্য প্রজাতি ব্যতিরেকেই বিশ্বজগত তার যাত্রা শুরু করেছিল, এবং নিশ্চিত ভাবেই তার সমাপ্তি ঘটবে এটা (মনুষ্য প্রজাতি) ছাড়াই।
আরও কিছু মন্তব্য এমন, “What else has man done except
blithely break down billions of structures and reduce them to a state in which they are
no longer capable of integration?”
“কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে লক্ষ-কোটি কাঠামোকে ভেঙেচুড়ে পুনরায়
একীভুতকরণের সম্ভাবনারহিত অবস্থায় নিয়ে
আসা ছাড়া, আর কোন কাজটা মানুষ করেছে? "
১৯৩৫ সালের দিকে ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ক্লদ লেভি স্ট্রস।
আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের শেকড়ের খোঁজে সে সময় আমাজনের গভীর অরণ্যে বেশ কয়েকটি নৃতাত্বিক অভিযান চালিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আমাজনের রেইন ফরেষ্টএ তিনি যে সব ভ্রমন অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তা নিয়েই লিখা তার এই আত্মজীবনী। ‘বিশ্বজগতে মানুষ এমন কোন সুবিধাজনক অবস্থায় নাই, তার অস্তিত্বের কোন ধরনের উল্লেখযোগ্য চিহ্ন
রেখে যাওয়া ব্যাতিরেকেই মানুষ একদিন
দুনিয়া থেকে নির্মুল হয়ে যাবে... এই ছিল ক্লদ লেভি স্ট্রসের বিশ্ববীক্ষা।
দুনিয়া থেকে মানুষ নির্মুল হয়ে যাবে কিনা, এ আশঙ্কা সম্ভবতঃ নতুন কোন চিন্তা নয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আনবিক বোমার ধ্বংশাত্মক ক্ষমতা আর তার পরে পরাশক্তি সমুহের ঠান্ডাস্নায়ুযুদ্ধের
কালে এই বোধ বেশ তীব্র ভাবেই সামনে এসেছিল, মুর্খ মুঢ় মানব
সন্তানেরা সত্যি সত্যি তাদের আত্মধ্বংশ ডেকে আনবে কিনা।
সামগ্রিক বিচারে এই আশঙ্কাও হয়তো চরম ছিল না, অন্ততঃ যুদ্ধ এলাকার বাইরের মানুষেরা ভাগ্যের কৃপা দাক্ষিণ্যে নিজদের নিরাপদ ভাবতে পারতো।
অথবা শক্তিমত্তার
ভারসাম্যে এগিয়ে থাকলে বিপদ এড়ানো গেলেও যেতে পারত। নির্মুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক কোন পিছিয়ে থাকা জনপদ,
মুছে যাক কোন শক্তিহীন দুর্বল জনগোষ্ঠীর নাম পৃথিবীর বুক থেকে। বিজয়ীদের
জন্যই তো এ জগত সংসার, কে না জানে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।
অতিরিক্ত উষ্ণ হয়ে উঠছে সমগ্র বিশ্বঃ
অতিরিক্ত উষ্ণ হয়ে উঠছে সমগ্র বিশ্বঃ
অথচ বিপদের দিক থেকে উঁচু নিচু মানুষ কিংবা উন্নত অনুন্নত জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে
এক নতুন ধরনের সাম্যাবস্থা এনেছে সম্ভবতঃ Global warming বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অগ্রসর অথবা পিছিয়ে পড়া
যে কোন জনসমষ্টির জন্যই সমান মাত্রার বিপদ নিয়ে সে হাজির। ভাগ্যের কৃপা অথবা শক্তিমান হওয়া কোনটাই যথেষ্ট নয় এই বিপদ থেকে নিজকে নিরাপদ
ভাবতে। ক্রমশঃ নাগরিক সভ্যতার বিস্তৃতির প্রক্রিয়ায়- শক্তির জন্য অতিমাত্রায় ফসিল ফুয়েলের (জীবাশ্মজ্বালানী) উপর নির্ভরতা, শক্তির উৎস হিসাবে প্রাকৃতিক শক্তির (সুর্যের আলো, নদীর স্রোত,
বায়ুপ্রবাহ) উপর নির্ভর না করা, সর্বোপরী শক্তির পুনঃপুনঃ ব্যবহারযোগ্যতা কে নিশ্চিত করতে পারার ব্যার্থতা প্রতিনিয়তই এই হুমকির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশ
প্রতিবেশকে হুমকির মধ্যে নামিয়ে এনে এও এক আত্মধ্বংশের প্রতিযোগিতা। প্রতিনিয়ত নিজেরাই লিখে চলছি নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা।
সারা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এই তাপমাত্রা বাড়ছে মুলতঃ পরিবেশে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া সমস্যা গ্রীনহাউস এফেক্টের জন্য। বলা হচ্ছে এই তাপমাত্রা যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তবে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে মেরু অঞ্চলের জমাট বাধা বরফ আর উঁচু পর্বতগুলোকে ঢেকে রাখা বরফে। এই বরফগুলো গলে যাওয়ার হার বেড়ে গেলে বিভিন্ন উপকুলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাবে, বিশাল এলাকা তলিয়ে যাবে পানির নিচে। বলা হচ্ছে গ্লোবাল টেম্পারেচার আর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই সম্ভাব্য বিপদের মধ্যে দুনিয়ার ৩০ থেকে ৪০ ভাগ প্রজাতির ধ্বংশ, আগের চেয়ে ব্যাপক তীব্র এবং ভয়ঙ্কর তাপ প্রবাহ এবং খরার উপস্থিতি, বন্যা সাইক্লোন সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি আর সেই সাথে সমুদ্রের পানির উচ্চতা অন্ততঃ ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এ সবের নিট ফলাফল, বিপন্ন হবে লক্ষ-কোটি মানুষের জীবন...
সারা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এই তাপমাত্রা বাড়ছে মুলতঃ পরিবেশে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া সমস্যা গ্রীনহাউস এফেক্টের জন্য। বলা হচ্ছে এই তাপমাত্রা যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তবে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে মেরু অঞ্চলের জমাট বাধা বরফ আর উঁচু পর্বতগুলোকে ঢেকে রাখা বরফে। এই বরফগুলো গলে যাওয়ার হার বেড়ে গেলে বিভিন্ন উপকুলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাবে, বিশাল এলাকা তলিয়ে যাবে পানির নিচে। বলা হচ্ছে গ্লোবাল টেম্পারেচার আর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই সম্ভাব্য বিপদের মধ্যে দুনিয়ার ৩০ থেকে ৪০ ভাগ প্রজাতির ধ্বংশ, আগের চেয়ে ব্যাপক তীব্র এবং ভয়ঙ্কর তাপ প্রবাহ এবং খরার উপস্থিতি, বন্যা সাইক্লোন সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি আর সেই সাথে সমুদ্রের পানির উচ্চতা অন্ততঃ ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এ সবের নিট ফলাফল, বিপন্ন হবে লক্ষ-কোটি মানুষের জীবন...
তো পরিবেশে কার্বন নিঃসরনের (Carbon
emission) হার বেড়ে যাওয়ার থেকে শুরু এই বিপর্যয় যা
নিঃশব্দ ঘাতকের মতো আমাদের ঘিরে ফেলছে — একটা বিষয় খুব পরিস্কার এখানে এই কার্বন
এমিসনের জন্য দায়ী একমাত্র মানুষ... অন্য কেউ নয়। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত মানুষই উগড়ে দিচ্ছে বিষাক্ত কার্বন...
এ হল খুবই সাধারন ভাবে কিছু নমুনা, যা তথ্য হিসাবে আমাদের মনে রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে আধুনিক মানুষের জীবন যত প্রযুক্তি নির্ভর এবং জটিল
হয়ে উঠছে কার্বন নিঃসরনের পরিমান ততো বাড়ছে। সভ্যতা,
উন্নতি, ভোগ বলতে যে মানদন্ড আমরা নিজেরা নির্ধারন করেছি তার ঘেরাটোপের মধ্যে আমরা নিজদের
আটকে ফেলেছি। আধুনিক
সভ্যতা বলতে আমরা এখনও বুঝি পশ্চিমা মডেল, উন্নতি বলতে বুঝি প্রযুক্তি নির্ভরতা। অন্ধভাবে পশ্চিমকে অনুসরন করে যাওয়া।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইস্যুকে আমাদের ভাবতে হবে পরিবেশ নিয়ে আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টি ভঙ্গী কি — সেই আলোকে। আমরা আরও সভ্য আরও উন্নত হতে গিয়ে আমাদের প্রকৃতিকে কিভাবে ব্যাবহার করছি— যে কোন উপায়ে প্রকৃতিকে পদানত করে, তার উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য এনে দানবীয় যে পদ্ধতিতে আমরা এ যাবত আমাদের প্রকৃতিকে ভোগ করেছি, আজ সময় এসেছে সে সব নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনা
করার। ষাট এবং সত্তরের দশক জুড়ে পশ্চিমাদের দেওয়া
প্রেশক্রিপশন অনুযায়ী আমরা উন্নয়নের যে রীতি-নীতি অনুসরন করেছি- তার খেসারত কি আমরা নানা ভাবে দিচ্ছি না? সবুজ বিপ্লবের নামে যথেচ্ছ টিউবওয়েল বসিয়ে ভুগর্ভস্থ পানি তুলে এনে আমরা কি আর্সেনিক এর বিষ সৃষ্টি করি
নাই? সব কিছুতে রাষায়নিক সার আর কীটনাশকের অবাধ ব্যাবহার আমাদের কে
শিখিয়েছে...?
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই ভীতিকর পরিস্থিতির জন্য আমরা আসলে নিজেরাই দায়ী। এর জন্য প্রয়োজন পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের
সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন নিজস্ব উন্নয়ন মডেল দাড় করানো, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত পশ্চিমা উন্নয়ন ব্যবস্থাপত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পরিত্যাগ করা। সচেতন থাকা,
যাতে করে পশ্চিমা প্রযুক্তির রমরমা জৌলুশ যেন আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে না দেয়।
ক্লদ লেভি স্ট্রস সারাজীবন কাজ করেছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে প্রচলিত পৌরাণিক মিথ, লোকজ গল্পগাথা, যুগের পর যুগ চলে
আসা নির্দিষ্ট অভ্যাস অথবা ভঙ্গী নিয়ে। প্রায় তিন দশক ধরে আমাজনের ইন্ডিয়ানদের জীবনাচরন ব্যাখা বিশ্লেষন করে দুনিয়ার যাবতীয় পৌরানিক
কাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। পৌরানিক মিথ ও প্রথার মৌলিক ধারনাকে তিনি বিশ্লেষন করে আবিস্কার করেছেন তার
অন্তর্নিহিত বিন্যাস, তার অভ্যন্তরীন প্যাটার্ণ। লোকজ স্থানীয় মিথ নিয়ে কাজ
করার সময় ক্লদ লেভি স্ট্রসের মিথলজি হয়ে যায় মিথলজিক। যুক্তি দিয়ে বোঝা লোককল্প। ফলে নির্দ্বিধায় তিনি দাবী করেন আদিম সমাজ নিয়ে তার তাত্ত্বিক অবস্থান- আদিবাসী মানুষের মানস বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত ভাবেই পশ্চিমা সভ্যতার
মানসের সমকক্ষ। যে কোন জাতিসত্ত্বার নিজস্ব চিন্তা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে যে ভাবনা প্রকাশ করে, পশ্চিমা যে কোন ভাবনার চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়।
বাংলাদেশ কি করবে?
উপকুলীয় অঞ্চলের বদ্বীপ হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকির পরিমান যে কোন এলাকার চাইতে অনেক বেশি। আমাদের
সমুদ্রের যা গড় উচ্চতা, তাতে সমুদ্রের পানির লেভেল ১মিটার বাড়লে দেশের
একটা বিশাল অংশ স্রেফ সমুদ্রের বুকে বিলীন হয়ে যাবে। এই বিপর্যয় কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা হয়তো
আমরা অনুমানও করতে পারছি
না। আমরা সত্যিই জানি না কারা আমাদের সাহায্য করবে, এমনকি বিপদের সেই মুহুর্তে কোন ধরনের সাহায্য আমাদের জন্য যথেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে কিনা!!
তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে আমাদের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখি- নিজ-অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু করার এটাই সেরা সময়। আমাদের উচিত হবে কারও ভরসায় না থেকে নিজদের করনীয়গুলো স্থির করা ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের সমস্যাগুলোর প্রকৃতি নিয়ে ব্যপক আলোচনা, মতবিনিময় এবং জনমত গঠনের কাজ শুরু করা। শুধু প্লেকার্ড, ব্যানার নিয়ে প্রজন্ম চত্ত্বর কিংবা প্রেস ক্লাবের সামনে ঘন্টা দু’য়েক দাড়িয়ে থেকে, মানুষের স্বাভাবিক চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে আপন মনে বাড়িতে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে গেলে হারিয়ে যেতে হবে সাগরের জলে।
তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে আমাদের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখি- নিজ-অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু করার এটাই সেরা সময়। আমাদের উচিত হবে কারও ভরসায় না থেকে নিজদের করনীয়গুলো স্থির করা ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের সমস্যাগুলোর প্রকৃতি নিয়ে ব্যপক আলোচনা, মতবিনিময় এবং জনমত গঠনের কাজ শুরু করা। শুধু প্লেকার্ড, ব্যানার নিয়ে প্রজন্ম চত্ত্বর কিংবা প্রেস ক্লাবের সামনে ঘন্টা দু’য়েক দাড়িয়ে থেকে, মানুষের স্বাভাবিক চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে আপন মনে বাড়িতে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে গেলে হারিয়ে যেতে হবে সাগরের জলে।
প্রকৃতির সপ্রাণ সচেতন অংশ হিসাবে প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্ক কিছুতেই খাদ্য খাদকের সম্পর্ক হতে পারে
না। প্রকৃতিকে নষ্ট করে, জীব প্রজাতি ধ্বংশ করে আমরা কোন ধরনের উন্নয়নই
চাইতে পারি না। পশ্চিমের অন্ধ অনুকরন না করে, বরং আমাদের উচিত
হবে নিজের ফাঁদে আটকে পড়া পশ্চিমা সভ্যতার কৃত ভুলগুলো এড়িয়ে চলা।
ক্লদ লেভি স্ট্রসের উপর আস্থা থাকলে আমাদের বিশ্বাস করাই উচিত প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠী তার নিজস্ব সংস্কৃতি আর জীবন
যাপনের পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যে মানসের ছবি ফুটিয়ে তোলে তা কোন অংশেই পশ্চিমা আধুনিক সভ্যতার
অন্তঃর্নিহিত মানসের চেয়ে
তুচ্ছ নয়। প্রত্যেক সংস্কৃতি তার নিজস্ব উদ্ভাসের ভেতর নিখিল ও জগতের একটা পরিপুর্ণ এবং স্বয়ম্ভু
কাঠামোকে আত্মস্ত করে রাখে। প্রয়োগ ও সাফল্যের দিক থেকে সে কাঠামো বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির মতোই স্বয়ংসিদ্ধ।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং – ঘটছে কিভাবে?
প্রাকৃতিক কারণেই পৃথিবীর ভুমি ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় আর তাপমাত্রার এই বৃদ্ধিই ‘গ্রীনহাউস এফেক্ট’ নামে পরিচিত। বায়ুমণ্ডলের কিছু গ্যাস যেমন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জলীয়বাষ্প ও
মিথেন ভূমি থেকে যে লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ ঘটে সেগুলোকে শোষণ করে, আর এর ফলেই
তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ শোষণকারী এই গ্যাসগুলোই গ্রীনহাউস
গ্যাস নামে পরিচিত। তাপমাত্রা বৃদ্ধিই প্রাণীর জীবন-ধারণের জন্য অত্যাবশকীয়।
বর্তমানে পৃথিবীর ভূমির তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গ্রীনহাউস এফেক্ট
না থাকলে পৃথিবীর তাপমাত্রা -১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে চাঁদের মত ঠাণ্ডা
শিলায় পরিণত হত, আর তার ফলে প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ত। আবার
গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর খুব বেশীও কাম্য নয়। শনির (ভেনাস) বায়ুমণ্ডলের ৯৬%
কার্বন-ডাই-অক্সাইড যা এর ভূমির তাপমাত্রাকে ৪৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস করে দেয়, তাই শনিও
বসবাসের অনুপযোগী। সূর্য থেকে যে তাপশক্তি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে
পৃথিবীতে আসে তার ২৬ ভাগ প্রতিফলিত হয়ে মহাশুন্যে ফিরে যায়, ১৯ ভাগ মেঘ, গ্যাস (ওজোন) ও
নানা কণিকা দ্বারা শোষিত হয়, যে ৫৫ ভাগ ভূমির কাছাকাছি আসতে পারে
তার ৪ ভাগ ভূমি থেকে প্রতিফলিত হয়ে মহাশুন্যে ফিরে যায়। শেষ পর্যন্ত
তাপশক্তির ৫১ ভাগ ভূমির কাছাকাছি থাকতে পারে, যা ভূমির
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ গলানো, জলীয়বাষ্প তৈরী ও সালোক-সংশ্লষণে কাজে লাগে।
দেখা যাচ্ছে, গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর কারণে তাপ ধরে রাখা হচ্ছে, অতএব, তাদের পরিমাণ
যত বেশী হবে পৃথিবীর তাপমাত্রা ততই বাড়তে থাকবে। আগেই বলা হয়েছে গ্রীনহাউস গ্যাসগুলো জীবন ধারণের জন্য দরকারী এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চক্রের মাধ্যমে তাদের পরিমাণ নির্ধারিত থাকে।
কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে
তাদের অতিরিক্ত পরিমাণ থেকে। ১৭০০ শতাব্দীতে ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রীনহাউস গ্যাসের আধিক্য পাওয়া যায়। ১৭০০ সালে যেখানে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড
এর পরিমাণ ছিল ২৮০ পিপিএম (পার্টস
পার মিলিয়ন), ২০১০ সালে তা
বেড়ে হয়েছে ৩৮০ পিপিএম। আরেকটি গ্রীনহাউস
গ্যাস মিথেন এর পরিমাণ ১৭৫০ সাল থেকে বেড়েছে ১৫০ ভাগ।
টেবিলঃ
গ্রীনহাউস এফেক্টের জন্য দায়ী গ্যাসগুলো – তাদের অতীত এবং
বর্তমানের ঘণত্ব ও উৎস
গ্রীন হাউস গ্যাস
|
ঘনত্ব
১৭৫০
|
ঘনত্ব
২০০৩
|
পরিবর্তনের হার
|
উৎস
|
কার্বন-ডাই অক্সাইড
|
২৮০পিপিএম
|
৩৭৬ পিপিএম
|
৩৪%
|
জৈব ক্ষয়, পুড়ানো বনজ সম্পদ, আগ্নেয়গিরি, জৈব জ্বালানি, বনভুমি উজাড়, ভুমির ব্যবহার, ইত্যাদি।
|
মিথেন
|
০.৭১ পিপিএম
|
১.৭৯ পিপিএম
|
১৫২%
|
জলাভুমি, জৈবক্ষয়, টার্মাইট, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের নির্যাস, জৈবসার, ধান উৎপাদন, গবাদিপশু ইত্যাদি।
|
নাইট্রাস অক্সাইড
|
২৭০ পিপিবি
|
৩১৯ পিপিবি
|
১৮%
|
বন, ঘাস, সমুদ্র, মাটি, সার, জৈবসার, জৈব জ্বালানী ইত্যাদি।
|
ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFCs)
|
০
|
৮৮০ পিপিটি
|
-
|
রেফ্রিজারেটর, এরোসল স্প্রে, প্রপেল্লান্ট ইত্যাদি
|
ওজোন
|
অজানা
|
আবহাওয়ার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংসের উপর নির্ভরশীল
|
স্ট্রাটোস্ফিয়ারে কমলেও ভুমির নিকট বৃদ্ধি পেয়েছে
|
প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের আলো দ্বারা অক্সিজেন থেকে সৃষ্ট এবং কৃত্রিমভাবে
ফটোকেমিক্যাল ধোয়া উৎপাদন থেকে সৃষ্ট।
|
১৮শো সাল থেকেই
পরিবেশে গ্যাস কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে
বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেন। ১৮২০ সালের দিকে গণিতবিদ জোসেফ ফুরিয়ার অনুমান করেন, সূর্য থেকে যে
তাপ আসে তা আবার মহাশুন্যে মিলিয়ে যায় না, কিছু একটা তাকে ধরে রাখছে। ১৮৬০ সালের দিকে আইরিশ পদার্থবিদ
জন টাইন্ডাল অনেক গ্যাস নিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক পর্যায়ে লক্ষ্য করেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের তাপ ধরে রাখার এক বিশেষ ক্ষমতা আছে। পরবর্তীতে
সুইডেনের নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী
আরহেনিয়াস, জন টাইন্ডালের কাজকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যান এবং ১৮৯৬ সালে তিনি
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার একটি যোগসূত্রকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান।
মজার ব্যাপার
হল, হৈচৈ বেশী হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে। অথচ সবচেয়ে প্রাচূর্যময় গ্রীনহাউস গ্যাসটি হল জলীয় বাষ্প! আসলে প্রাচূর্য থাকাটাও সমস্যা না। কারণ
দেখা গেছে এই জলীয় বাষ্পের পরিমাণ
বছর বছর তেমন একটা পরিবর্তন হয় না, আর তাইতো
বৈষ্ণিক উষ্ণতা বাড়াতে একে
দায়ী করা হয় না। তবে, জলীয় বাষ্পের
পরই সবচেয়ে বেশী বিরাজমান গ্রীনহাউস
গ্যাসটি হল এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আর গ্রীনহাউস গ্যাসের কমপক্ষে ৫৫ ভাগই আসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে। এখানে লক্ষ্যণীয়
ব্যাপার হল, গ্রীনহাউস গ্যাস মিথেনের এক কেজি পরিমাণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণের চেয়ে ২৫ গুণ
বেশী তাপ ধরে রাখতে পারে। কিন্তু ভাগ্য ভাল বাযুমণ্ডলে এই গ্যাসের পরিমাণ খুব কম। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যেখানে ৩৮৮ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) সেখানে মিথেনের
পরিমাণ মাত্র ১.৮ পিপিএম। অপরদিকে নাইট্রাস অক্সাইডের ১ কেজি পরিমাণ
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণের
চেয়ে ২৯৮ গুণ বেশী তাপ ধরে রাখতে পারে। কিন্তু নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ মাত্র 0.৩ পিপিএম।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) ছাড়াও আরো আছে
বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন যেমনঃ হাইড্রোফ্লুরোকার্বন (HFCs), পারফ্লুরোকার্বন (PFCs), সালফার
হেক্সাফ্লুরাইড (SF6)। বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন গ্যাসগুলোর তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা
আরো বেশী হলেও এদের পরিমাণ
বায়ুমণ্ডলে খুবই কম যে তাদের গণনায় সেভাবে নেয়া হয় না।
কিন্তু, এতো কার্বন-ডাই-অক্সাইড এল কোথা থেকে! প্রতিবছর যেসব উৎসগুলো থেকে
কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে আসে সেগুলো হলঃ
১। আগ্নেয়গিরির
অগ্ন্যুৎপাত থেকে বায়ুমণ্ডলে আসে ০.৪ পিপিএম এবং এর সমপরিমাণ আবার বায়ুমণ্ডল থেকে
শুষে নেয়া হয়। (সমান-সমান)
২। সমুদ্র থেকে
বায়ুমণ্ডলে আসে ৩৩২ পিপিএম, আর এর বিপরীতে
বায়ুমণ্ডল থেকে শুষে নেয়া হয় ৩৪০ পিপিএম। (অতিরিক্ত শুষে নেয়া হয় ৮ পিপিএম)
৩। বনসম্পদ
উজার, জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে আসে ৪৪৪ পিপিএম আর এর বিপরীতে সালোক-সংশ্লেষণ ও বনায়নের ফলে শুষে নেয়া হয় ৪৪৯ পিপিএম। (অতিরিক্ত শুষে
নেয়া হয় ৫ পিপিএম)
৪। জীবাষ্ম
জ্বালানী পোড়ানোর ফলে প্রতিবছর বায়ুমণ্ডলে আসে
২৮ পিপিএম, কিন্ত শুষে নেয়ার কোন উৎস না থাকায় তা বায়ুমণ্ডলেই থেকে যায়। (অতিরিক্ত থেকে যাচ্ছে ২৮ পিপিএম)
দেখা যায়
জীবাষ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড
বায়ুমণ্ডলে যোগ হয় তা অন্য কোন উৎস থেকে কিছু শুষে নেয়া হলেও উদ্বৃত্ত কিছু থেকে যাচ্ছে। অবশ্য, কার্বন-ডাই-অক্সাইড
যে কেবল জীবাষ্ম
জ্বালানী থেকেই আসে তা না, সিমেন্টের
প্লান্ট থেকেও প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড
উৎপন্ন হয়। কারণ সিমেন্ট তৈরীতে যে শিলাখণ্ড ব্যবহার করা হয় তা থেকে উচ্চতাপে লাইম ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়। এর ফলে প্রতিবছর ০.৯ বিলিয়ন টন অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড
বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং- সভ্যতার খোলসে অমানবিকতা!
জানা দরকার এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য
দায়ী কারা। আগেই বলা হয়েছে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর
থেকেই বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে! গ্লোবাল ওয়ার্মিং
এর প্রধান দায় সেইসব সভ্যতার চালক উন্নত সব পূঁজিবাদী দেশগুলোর। সবচেয়ে
বেশী চীন, তারপর
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, জাপান, জার্মানী, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি। প্রথম দেশটি
যুক্তরাষ্ট্রই ছিল, কিন্ত পূজীবাদের দিকে
ধাবিত হবার পর চীন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে
ছাড়িয়ে গেছে। চীনের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমণের এক-তৃতীয়াংশ আবার
রপ্তানীর সাথে জড়িত। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রতিবছর ২০০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এর বেশী কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন
করে, আর
বাকী দেশগুলো করে ১০০০ মিলিয়ন মেট্রিকটন এর
বেশী কার্বন-ডাই-অক্সাইড। ঐতিহাসিক ইউএন ডাটা থেকে পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৮৫০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যেসব
দেশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী সেগুলার মধ্যে প্রধান হলঃ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সৌভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, জার্মানী, চেকশ্লোভাকিয়া, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, পোলান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জাপান, ইটালী, রোমানিয়া, সাউথ আফ্রিকা, সউদী আরব, স্পেন, সাউথ কোরিয়া, আর্জেন্টিনা ও ইরান।
এমনকি উন্নত বিশ্বের স্বার্থরক্ষাকারী বিশ্বব্যাঙ্কও কম যায় না। ডব্লিউ ডব্লিউ
এফ এর ২০০৮ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক
যে এনার্জি প্রজেক্ট নেয় সেগুলো ২৬ গিগাটন এর মত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নি:সরণ
করে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, জাপান, জার্মানী মোট
কার্বন-ডাই-অক্সাইড (জীবাষ্ম জ্বালানী ও সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রী) নিঃসরণের প্রায় ৬০
ভাগের জন্য দায়ী। আর এই তথ্য উক্ত দেশগুলোর সরকারী হিসাবের উপর ভিত্তি করে পাওয়া গেছে। কিন্তু এর বাইরেও ‘ডার্ক’ কিছু অংশ রয়েছে যা
হিসাবের বাইরে। আবার মধ্যপ্রাচ্য সবচেয়ে
বেশী অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করলেও বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের প্রথম ১০ টি
দেশের মধ্যে তারা নেই। এদিকে
চীন ও ভারতে যে এনার্জির ভোক্তা তার সিংহভাগই অল্প কিছু ধনীর
মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর জন্য
উন্নত দেশগুলোর একধরণের অনীহা দেখা যায়।
ছবি১ঃ ১৮৫০ সাল থেকে কার্বন নিঃসরণের
পরিমাণ, বিলিয়ন
টনে (সার্কেল চিহ্নিত অংশ নির্গমণ এলাকা)
ফুটবল পিচের মত আয়তনের রেইনফরেস্ট প্রতি
চার সেকেন্ডে ধ্বংস হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৩ মিলিয়ন
হেক্টর বনভুমি ধ্বংস হয়। মানুষ একবছরে যা ধ্বংস করে তার সমপরিমাণের বনভুমি
উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজন ১.৫ বছর। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল ৪২,৩২৯,০০০ হেক্টর বন ধ্বংস
করে যার আয়তন জার্মানীর সমান। ব্রাজিল বিশ্বের
সবচেয়ে বড় গরুর মাংসের যোগানদাতা, আর গবাদি পশুর চারণভুমির
জন্য এ বনসম্পদ ধ্বংস করতে হয়। ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই বনসম্পদের ৪০ ভাগ
আমাজানে, আর
তা আমাজানের ইকোসিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। দেখা যায়, বামপন্থী প্রেসিডেন্ট
লুলার হাত ধরে পুজিবাদের দিকে ধাবিত ব্রাজিলও কম যায় না।
চিত্র২ঃ ধনী দেশগুলো পরিবেশ বিপর্যয়ের
জন্য দায়ী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মানিয়ে চলার সামর্থ্যও বেশী।
তেল, কয়লা গ্যাস, এই জীবাষ্ম জ্বালানীই
হল এই পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী। এসবের প্রধান ভোক্তা
উন্নত বিশ্ব। বর্তমানে পৃথিবীতে যে বিদ্যুৎ উপাদন হয় তার শতকরার ৪১ ভাগের
জ্বালানীই হল এই কয়লা। খুব সস্তা ও প্রাচূর্য থাকায় একে যথেচ্ছাভাবে
ব্যবহার করা হচ্ছে যার প্রধান ভোক্তাও সেই উন্নতবিশ্ব। ইন্টারগভর্মেন্টাল
প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) এর ১০০০ এর মত বিজ্ঞানী
শিল্পবর্জ্যকে পরিবেশের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর প্রতিক্রিয়াস্বরুপ দেশগুলো টোকিওর
কিয়োটোতে সন্মেলন করে এই গ্রীণহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি রোধ করার
জন্য। কিন্তু পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী
যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। অথচ এ সন্মেলনে যে
গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হয় তা ছিল খুব সামান্য।
মুনাফাখোর বড় বড় সব ব্যবসায়িক
প্রতিষ্ঠান জলবায়ূর পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে তাদের সবচেয়ে
অগ্রভাগে পাওয়া যাবে এনার্জি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। যেমনঃ এক্সন-মবিল
মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে পরিবেশ-বিজ্ঞানের বিপরীত ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ কে শক্তিশালী করার
জন্য। অষ্ট্রেলিয়ার দ্যা ইন্সটিটিউট অব পাবলিক
এফেয়ার্স যেটি কিনা জলবায়ুর এই পরিবর্তনকে অস্বীকারকারী হিসাবে জনগণকে
এর বিপরীতে উলটা ধারণা দিচ্ছে তারা সেদেশের কয়লা, তেল ও গ্যাস কোম্পানী
থেকে খুব বড় অঙ্কের অনুদান পেয়ে থাকে। অন্যান্য ধনী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই
জলবায়ুর পরিবর্তনকে অস্বীকার করে, কারণ এর দ্বারা তাদের ব্যবসার মাধ্যমে
মানুষের ভোগকেই নিবৃত্ত করার করারই চেষ্টা হিসেবে দেখে। আমেরিকান ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হার্টল্যান্ড
ইন্সটিটিউট পরিবেশের পরিবর্তনকে অস্বীকার করাকে
প্রমোট করে, যারা
অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ধনী ব্যক্তিবর্গ থেকে
অনুদান নিয়ে থাকে। এইসব জলবায়ূর পরিবর্তনকে অস্বীকারীরা এই ফাকে বড়
অঙ্কের মুনাফাও করছে। যেমনঃ ইয়ান প্লাইমার দুই বছরে শুধুমাত্র খনিজ
উত্তোলন প্রতিষ্ঠানকারীদের বৈঠকে উপস্থিত থেকে দুই বছরে আয়
করেছে প্রায় $৪০০,০০০ ডলার, বলা যায় খুব সহজ টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের চেম্বার অব কমার্স, কোচ ব্রাদার্স, আমেরিকান ফর প্রসপারিটি
ও রক্ষণশীল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কাটো ইনস্টিটিউট, আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ
ইনস্টিটিউট জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবর্তনের ব্যাপারে মানুষকেই মিসগাইড
করতে টাকা ঢালে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আটলাম ইকনমিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাজ্যের
ইন্ট্যারনেশনাল পলিসি নেটওয়ার্ক এক্সন মবিলের মত তেল কোম্পানীগুলো
থেকে হাজার হাজার পাউন্ড নিয়ে থাকে, উদ্দেশ্য পরিবেশের পরিবর্তন
নিয়ে মানুষকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়া।
সারা পৃথিবীব্যাপী এরকম ৫০০ এর মত প্রতিষ্ঠান আছে যারা
যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে বৈষ্ণিক
উষ্ণতার বিপক্ষে প্রপাগান্ডা চালিয়ে থাকে। ইউনিয়ন অব কনসার্ণড সাইন্টিস্টদের
একটা গ্রুপ দাবী করে যে ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এক্সন মবিল ৪৩টি
এডভোকেসি প্রতিষ্ঠানকে ১৬ মিলিয়ন ইউ এস ডলার দেয়া হয় জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে
মানুষকে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্য। জলবায়ুর পরিবর্তনকে অস্বীকারকারীরা
এতটাই বেপরোয়া যে ২০০৮ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সন্মেলন এর আগে
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত ই-মেইল হ্যাক করে।
তেল ও গ্যাস কোম্পানীগুলো তাদের
লবিষ্টদের মাধ্যমে রাজনীতিতে তাদের হাতকে প্রসারিত করতে সমর্থ হয়েছে। দেখা
গেছে, তেল
ও গ্যাস কোম্পানীগুলো, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে লবিং করার জন্য ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার খরচ
করে। বিখ্যাত তেল ব্যবসায়ী ডেভিড কোচ ও তার ভাই চার্লস ৫৫ মিলিয়ন
ইউএসডলার বিনিয়োগ করে বৈষ্ণিক উষ্ণতার ব্যাপারে পলিসি ও নিয়মকানুন তৈরিকে
দীর্ঘায়িত করার জন্য। ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়লা, তেল ও গ্যাস
কোম্পানীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের ১১৪ মিলিয়ন ডলার দেয়। জর্জ বুশ
নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য নেন ১.৭ মিলিয়ন ডলার। এই বিক্রীত
রাজনীতিকরা পরিবেশ আন্দোলনে সবরকম প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে তৎপর
থাকে। ২০০৭ সালে জলবায়ূ বিজ্ঞানীদের উপর করা এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫৮
ভাগই বলেছে তারা জার্নাল প্রকাশের ব্যাপারে রাজনৈতিক চাপের স্বীকার। ২০০০
সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে
বৈজ্ঞনিক গবেষণাকে ধ্বংস করা, মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট উষ্ণতার তথ্যকে
মুছে ফেলতে এমনকি যারা জলবায়ূর পরিবর্তন নিয়ে উচ্চবাক্য করত তাদের
কেরিয়ারকে ধ্বংস করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। সবচেয়ে দৃষ্টিকটূ হয়
যখন বুশ প্রসাশন ২০০১ সালে কিয়োটো সন্মেলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে হারিকেন ক্যাটারিনা আঘাত হানার পর নাগরিকদের মধ্যে
বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের ব্যাপারে সচেতনতা বেড়ে যায়। এর সুত্র ধরেই উন্নত দেশগুলোর
সংস্থা জি-৮ ২০০, ২০০৫ সালে স্কটল্যান্ডের সন্মেলনে জলবায়ূর
পরিবর্তন ইস্যুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। বুশ প্রসাশনের বিদায়ের পর তুলনামূলক
ভাল ডেমোক্রেট বারাক ওবামার প্রসাশনের সময়ে ২০০৯ সালে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ
কোপেনহেগেনে জলবায়ু ইস্যুতে সন্মেলনে বসে, কিন্তু তাও অর্থবহ ফলাফল
ছাড়াই শেষ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা
ঐতিহ্যগতভাবেই জলবায়ূর পরিবর্তন অস্বীকারকারী হিসেবে পরিচিত। তবে
ডেমোক্রেটরাও যে পিছিয়ে, তা না। কারণ শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষই
তাদের কর্পোরেট বাণিজ্যকে রক্ষা করে। উন্নত বিশ্বের ডান-পন্থী দলগুলো
সরকারে বা বিরোধীদলে যেখানেই থাক না কেন, এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড
কমানোর বিপক্ষে সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তারকারী। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮
সালে সরকার ৫৫০ বিলিয়ন ইউএস ডলার সাবসিডি দেয় জীবাষ্ম জ্বালানীর
প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ভিতর ভিতর তাদের যে ট্যাক্স ও অন্যান্য সুবিধা দেয়া
হয় তা উহ্যই থাকে। অপরদিকে ২০০৯ সালে সরকার মাত্র ৪৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার
খরচ করে রিনোয়েবল এনার্জির জন্য! ২০০২ থেক ২০০৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র
সরকার একাই ৭২.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার সাবসিডি দেয় জীবাষ্ম জ্বালানীর জন্য। ২০০৫
থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে অষ্ট্রেলিয়ার সরকার জীবাষ্ম জ্বালানীর উৎপাদনের
জন্য ৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ করে, যার মধ্যে কয়লার জন্য খরচ
হয় ১.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
চিত্র৩ঃ ফক্স নিউজের জলবায়ুর পরিবর্তনকে
অস্বীকারকারী অবস্থান
পূজিবাদের স্বার্থরক্ষাকারী সংবাদপত্রও
জলবায়ুর পরিবর্তনের ব্যাপারে মিথ্যা সংবাদ বা সত্যকে চাপা দিয়ে
মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসে মিডিয়া মুঘল রূপার্ট
মারডকের প্রথম সারির সংবাদপত্র যেমনঃ ফক্স (উত্তর আমেরিকায়), টাইমস, সান (ইংল্যান্ডে), অষ্ট্রেলিয়ান (অষ্ট্রেলিয়ায়)
ইত্যাদি। একটি একাডেমিক লেখায় বিজ্ঞানীরা দাবী করেছেন, ফক্স নিউজ
উদ্দেশ্যমূলকভাবে জলবায়ূর পরিবর্তন নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে। ফক্স
নিউজের সংবাদের ৬০ ভাগই থাকে জলবায়ূর পরিবর্তনের বিপক্ষে আর মাত্র ২০ ভাগ
একে সমর্থন করে।
চিত্র৪ঃ জলবায়ূর পরিবর্তনের প্রভাব
বাড়তে থাকলেও সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যের সংবাদপত্রগুলোর জলবায়ূর ব্যাপারে নিন্মমূখী
কভারেজ।
The Inquisition of Climate Science বইতে জেমস পাওয়েল
দেখিয়েছেন মারডকের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফক্স নিউজ এর সাথে সাথে ওয়াশিংটন
পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসকেও দায়ী করেছেন। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
সমর্থনই পরিবেশ আন্দোলনকে জটিল করে ফেলেছে। আসলে পাশ্চাত্যের এই সব
মিডিয়া তাদের নিও-কনদের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে। কারণ সব
হিসাব-নিকাশ করলে ঐসব মিডিয়াও শেষপর্যন্ত অভিজাতদেরই প্রতিনিধিত্বকারী। তাইতো মিডিয়াতে
পরিবেশের পরিবর্তনের উপর কভারেজ কমে গেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে করনীয়ঃ
বাতাসে
কার্বন গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে
২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখা যায়, তাহলে এই পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে
বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু সেটা
কীভাবে সম্ভব?
তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। সবচেয়ে
ভালো মাঝারি ও কম-ভালো সমাধান বের করার জন্য তিনজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ পাঁচজন জলবায়ু
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত একটি কমিটি হিসাব করে দেখেছে যে, যদি সেই ঈপ্সিত ২ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের মধ্যে উষ্ণায়ন সীমিত রাখতে হয়, তাহলে ২১০০ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উত্পাদন
(জিডিপি) প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৪০ ট্রিলিয়ন (৪০ লাখ কোটি) ডলার কমে যাবে। জলবায়ু-ক্ষতির
চেয়ে এটা হবে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতি। আর যদি কার্বন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে
বাস্তবায়ন করা না যায়, তাহলে এই ক্ষতি আরও ১০ বা ১০০ গুণ বেশি হবে।
এ অবস্থায় চীন বলছে, তারা কার্বন নিঃসরণ কমাবে কিন্তু
প্রবৃদ্ধি ঠিক রেখেই। কীভাবে? তারা এমন প্রযুক্তি বের করবে যেন আগের চেয়ে কম কয়লা পুড়িয়ে
বেশি শক্তি পাওয়া যায়। অর্থাত্ আরও দক্ষভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার, পানি বিদ্যুত্,
সৌর বিদ্যুত্ প্রভৃতি বেশি করে ব্যবহার ইত্যাদি। ডেনমার্ক ইতিমধ্যেই ‘ক্লিন এনার্জি’
বা ‘গ্রিন এনার্জি’ ব্যবহার বাড়াচ্ছে, এর অন্যতম হলো বায়ু-বিদ্যুত্।
এ
ছাড়া বিভিন্ন দেশে ও প্রতিষ্ঠান থেকে নানা প্রস্তাব আসছে। এদের অন্যতম হলো ‘জলবায়ু-প্রকৌশলী-প্রযুক্তি’
(ক্লাইমেট-ইঞ্জিনিয়ারিং-টেকনোলজি)। যেমন— জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানি আকাশে এমনভাবে ছিটিয়ে
দেওয়া হবে, যেন তা আকাশে মেঘের আস্তরণ সৃষ্টি করে। এই পানির আবরণে সূর্যের কিছু আলো
প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যাবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাবে। ডেনমার্কে নতুন প্রযুক্তির
‘লো-এনার্জি হাউজিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যার সাহায্যে কম বিদ্যুত্ ব্যবহার
করে বাসার সব কাজ করা যায়।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যদি বিকল্প কৌশল হিসেবে বাতাসের
কার্বন শুষে নেওয়ার অব্যর্থ একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যায়, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয়
রোধ অনেক সহজ হবে। কোপেনহেগেন গ্লোবাল এডিটরস ফোরামে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিত্জ বলেছেন, এ বিশ্ব জগতে যদি মানুষের বসবাসযোগ্য
আরও দু-তিনটা গ্রহ থাকত, তাহলে চিন্তা ছিল না, জলবায়ু-অভিশাপ এড়াতে মানুষ এ পৃথিবী
ছেড়ে ওই সব গ্রহে চলে যেত। কিন্তু পৃথিবী তো একটাই, বসবাসযোগ্য অন্য কোনো গ্রহ তো নেই।
তাই এই পৃথিবীকে বাঁচাতেই হবে।
বিশ্বের
প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকারে
পরিণত হতে পারে। সুতরাং এখনই তত্পর হতে হবে। অপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
তবে
আমরা তো পারি সবুজের আশ্রয়ে ছায়া সুনিবিড় শ্যামল বাংলা গড়ে তুলতে। আমরা পারি আমাদের
একক বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরের আসেপাশে একটি বাগান ঘরে তুলতে। শিল্পায়নের দিকে সবাই ঝুকে
পরলে সবুজের বিলীনতার খবর কে রাখবে?
আমি
রাখব, আমরা রাখব,
একেক করে সব বাঙালী রাখবে যদি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে আমাদের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখি। নিজ-অস্তিত্ব
রক্ষার লড়াই শুরু করার এটাই সেরা সময়। আমাদের উচিত হবে কারও ভরসায় না থেকে নিজদের করনীয়গুলো স্থির করা
ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের সমস্যাগুলোর প্রকৃতি নিয়ে ব্যপক আলোচনা, মতবিনিময় এবং জনমত গঠনের কাজ শুরু করা। আমাদের দেখেই তো আগামী প্রজন্ম শিখবে পৃথিবীকে কি ভাবে
বাঁচাতে হয়। শুধু প্লেকার্ড,
ব্যানার নিয়ে প্রজন্ম চত্ত্বর কিংবা প্রেস ক্লাবের সামনে ঘন্টা দু’য়েক দাড়িয়ে
থেকে, মানুষের স্বাভাবিক চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে আপন মনে বাড়িতে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতে
হারিয়ে গেলে হারিয়ে যেতে হবে সাগরের জলে।
আসুন আজ
আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে বনায়ন সৃষ্টি করি, বাচাই দুস্বপ্নের হাত থেকে যা ধ্বংশের
অপেক্ষায় আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন